মোঃ তানজিলুল ইসলাম লাইক, রাজশাহী:
রাজশাহীতে চলছে পুকুর ভরাট আর গাছ কাটার মহোৎসব। রাতের অন্ধকারে পুকুর ভরাট, শতবর্ষী গাছ কেটে ফেলা, একের পর এক উন্নয়নের নামে প্রকৃতির উপর আঘাত—সবকিছু চললেও প্রশাসন যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এলাকার মানুষ অভিযোগ করছে, সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে, মানববন্ধন হচ্ছে, এমনকি ডিসি অফিস থেকে শুরু করে পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিকবার স্মারকলিপি জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কিছুদিনের জন্য সামান্য ব্যবস্থা নেওয়া হলেও পরবর্তীতে আবারও একই কাজ শুরু হয়ে যাচ্ছে।
খুলিপাড়া, আইটি বাগানপাড়া, নগরের বিভিন্ন এলাকায় পুকুর ভরাট বন্ধ করতে গেলে সামান্য অভিযান চালিয়ে আবার থেমে যায় প্রশাসন। পরিবেশ অধিদপ্তর কাগজে-কলমে মামলা বা জরিমানার কথা বললেও বাস্তবে কয়টা পুকুর উদ্ধার হয়েছে তা প্রশ্নের মুখে। গত পাঁচ বছরে মাত্র দুটি পুকুর পূর্ণ খনন করা হয়েছে, আর তিন থেকে পাঁচটি মামলার কথা শোনা গেলেও প্রকৃত ফলাফল মানুষ দেখেনি।
এদিকে ওয়াসা, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (রামেবি) ও সার্কিট হাউস এলাকায় তিনটি প্রকল্পে মোট ২,৩২৩টি গাছ কাটা হবে। যার মধ্যে অনেক গাছ কাটা শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্যে বহু পুরোনো ও মূল্যবান গাছও রয়েছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, এসব গাছ নগরীর জীববৈচিত্র্য ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। সম্প্রতি প্রাণ কোম্পানি রাজশাহীর এক প্রান্তে শত বছরের পুরোনো গাছ কেটে কারখানা নির্মাণ শুরু করেছে। নগরের বায়ুমান রক্ষা ও পরিবেশ সুরক্ষায় এসব গাছ অপরিহার্য ছিল।
শুধু এ বছরই বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠন জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনে ১৫টিরও বেশি স্মারকলিপি দিয়েছে। একই সঙ্গে হয়েছে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, প্রতিবাদ কর্মসূচি। কিন্তু প্রশাসন কেবল আশ্বাস দিয়েই থেমে আছে।
ইয়ুথ এ্যাকশন ফর সোস্যাল চেঞ্জ (ইয়্যাস) সংগঠনের সাধারণ- সম্পাদক মো. আতিকুর রহমান আতিক বলেন, “রাজশাহীর মানুষের প্রাণের জায়গা এই পুকুরগুলো, আর পুরোনো গাছগুলো আমাদের পরিবেশের সুরক্ষা বর্ম। কিন্তু একের পর এক পুকুর ভরাট হচ্ছে, গাছ কাটা হচ্ছে। আমরা বারবার অভিযোগ করছি, স্মারকলিপি দিয়েছি, মানববন্ধন করেছি, সংবাদ প্রকাশ করেছি—কিন্তু প্রশাসন দ্রুত আইন গত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও বাস্তবে সেটা সম্পূর্ণ হয়না। কয়েকদিন পর আবার একই জায়গায় নতুন করে কাজ শুরু হয়। ডিসি অফিস আর পরিবেশ অধিদপ্তর কেবল কথায় সীমাবদ্ধ, কাজে নয়। আমরা মনে করি প্রভাবশালীদের চাপে তারা নিরব থাকে। এখনই স্থায়ী সমাধান না হলে রাজশাহী আর বাসযোগ্য শহর হিসেবে টিকে থাকবে না।”
রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, “আমাদের কার্যক্রম চালাতে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া বড় পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। জনবলও কম। তবু আমরা কয়েক জায়গায় অভিযান চালিয়েছি, জরিমানা করেছি, কাজ বন্ধ করেছি। কিন্তু ভরাটকারীরা আবারও শুরু করে দেয়। আমাদের আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা সীমিত, তাই অনেক সময় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়। তবে আমরা চেষ্টা করছি স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু এককভাবে আমাদের পক্ষে সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।”
অভিযোগ, সংবাদ প্রকাশ, স্মারকলিপি আর মানববন্ধনের পরও প্রশাসনের নীরবতা এখন সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন—এভাবে পুকুর ভরাট আর গাছ কাটতে থাকলে রাজশাহীর আবহাওয়া, জলবায়ু আর মানুষের জীবিকা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।