বিপ্লব মজুমদার, সাতক্ষীরা :
শিল্পীর শিল্প কর্মই শিল্পীকে স্বনামে পরিচিতি দেয়। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্য জগতের বিশেষত বাংলা কাব্য জগতে একজন অসামান্য শিল্পী। তিনি ১৮৯৯ সালের ২৪ শে মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসনসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সবার কাছে বিদ্রোহী কবি হিসেবে অধিক পরিচিত হলেও তিনি একাধারে বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি,মানবতার কবি, প্রেমের কবি।মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে কবি ও তাঁর পরিবার চরম দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করতে থাকে। এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় কবিকে কাজ করতে হয় আসানসোলের রুটির দোকানে, ১২ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন লেটোর দলে এবং সেখানে রচনা করেন পালাগান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডঙ্কার ধ্বনি নজরুলকে যেমন আন্দোলিত করেছিল, সেই আন্দোলিত মনন ও প্রয়োজনবাদের তাগিদে তিনি ১৯১৭ সালে বাঙালি পল্টনে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। সেই সময়ের অনুরণন ও অনুধাবনের রূপের প্রকাশ পাই ১৯২৮ সালে শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া ‘ নতুনের গান ‘ এর মধ্য দিয়ে। বা পরবর্তীকালে ‘চল চল চল ‘নামে বাংলাদেশের রণ সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়।
নজরুলের বিদ্রোহ ছিল ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিপক্ষে। বিদ্রোহই তার জীবনের একমাত্র অভিজ্ঞান নয় বরং তার বিদ্রোহ প্রেমের জন্য, ভালোবাসার জন্য ন্যায়ের জন্য, সর্বোপরি মুক্তির জন্য। এজন্য তার কবিতায় প্রেম ও দ্রোহ একসাথে ধ্বনিত হয়ছে-“মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য” এখানেই তিনি সফল ও সার্থক। শুধু ভালোবাসা কিংবা দ্রোহ থাকলেই জীবনের প্রকৃত অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায় না। অস্তিত্বের স্বস্তি মেলে প্রেম ও দ্রোহের সমান্তরাল সান্নিধ্য। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদেরকে সেটাই দেখিয়ে দিলেন কি চমৎকার শব্দ মাধুর্যে। শুধু কী তাই! নারীর অধিকার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ধনী গরিবের সাম্যতা সবকিছুই কাজী নজরুল আমাদের শিল্প সাহিত্যকেই ছুঁয়ে গেলেন না আমাদের হৃদয়, জীবন ও সমাজ বাস্তবতাকে স্পর্শ করে গেলেন দৃঢ়তার আভিজাত্যে। তাঁর কবিতার কয়েকটি চরণ উচ্চারণ করলেই সেটা স্পষ্ট তো বোঝা যায়-“ কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পূরুষের তরবারী;প্রেরনা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়ালক্ষী নারী ” কিংবা “গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম ক্রিশ্চান।
গাহি সাম্যের গান।” অথবা “দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?” এমনিভাবে সবকিছুতেই কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সাহিত্যের সাথে জীবনকে এবং জীবনের সাথে দৈনন্দিন সমাজকে উপস্থাপন করেছেন সুনিপুণ শিল্প কুশলতায় ।
কাজী নজরুল ইসলাম শুধু কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যকে রাঙিয়ে দেননি,তাঁর গল্প,উপন্যাস,প্রবন্ধ সবকিছুতে সংযোগ আছে জীবন প্রবাহের।আবেগের সাথে আবহ ও অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বাস্তবতার নিটোল ফ্রেমে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্র উপন্যাস “বাঁধন হারা” তে উঠে এসেছে মাহবুবা-নুরুর প্রেম কিন্তু সেই প্রেমের পরিণতির আগ মুহূর্তে নুরুর পালিয়ে গিয়ে দৈনিক জীবন গ্রহণ যেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি কে স্পর্শ করে যায়। তাঁর “মৃত্যু ক্ষুধা ” উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজ জীবনের বাস্তবতা ও নারী জীবনের হাহাকার অনুভূতি। “রাজবন্দীর জবানবন্দী” প্রবন্ধে উঠে এসেছে প্রহসনমূলক বিচার ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। এছাড়া তাঁর রচিত গান গুলো হয়ে উঠেছে গণমানুষের আবেদন, অনুভূতি ও প্রেমের উজ্জ্বল মেলবন্ধন। এখানেই কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলা সাহিত্য অঙ্গনেই নয় আমাদের বাঙালি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই প্রাসঙ্গিক। জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই মহাপ্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।