ফিচার, লেখক, মো: জান্নাতী নাইম//
রংপুরের সবুজ বাগানের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তাজহাট জমিদার বাড়ি। রাজকীয় ইতিহাস, ইউরোপীয় স্থাপত্য এবং শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার এক অনন্য সংমিশ্রণ।
রংপুর শহরের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এক নিঃশব্দ রাজপ্রাসাদ হচ্ছে তাজহাট জমিদার বাড়ি। সবুজ লন ও গাছপালার মাঝে এই প্রাসাদ যেন এক সময়ের রাজত্বের গল্প বলে। শত বছরের পুরনো এই বাড়ি শুধু স্থাপত্যের নজির নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার এক জীবন্ত পাঠশালা।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রংপুরের জমিদার ও হীরার ব্যবসায়ী মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় বাহাদুর তাজহাট প্রাসাদ নির্মাণ করেন। “তাজহাট” নাম এসেছে ‘তাজ’ (মুকুট) এবং ‘হাট’ (বাজার) থেকে, যা প্রাসাদের রাজকীয় ঐশ্বর্য ও হীরার ব্যবসার প্রতীক। ব্রিটিশ আমলে এটি প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
দুই তলা বিশিষ্ট প্রাসাদটিতে ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলী স্পষ্ট। সাদা মার্বেলের কেন্দ্রীয় সিঁড়ি, গম্বুজাকৃতি ছাদ, খিলানবদ্ধ জানালা, লাল ইটের দেয়াল—সবই রাজকীয় মর্যাদা দেয়। কেন্দ্রীয় সিঁড়ির পাশে খোদাই করা পিলার প্রাচীন কারিগরদের দক্ষতার নিদর্শন বহন করে। প্রাসাদের সামনে বিস্তীর্ণ বাগান ও লাল ইটের রাস্তা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
১৯৯৫ সালে সরকার প্রাসাদটিকে সংরক্ষিত স্থাপনা ঘোষণা করে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুর মিউজিয়াম। এখানে রয়েছে পাল ও সেন যুগের মূর্তি, প্রাচীন মুদ্রা, আরবি ও ফারসি লিপির শিলালিপি এবং মধ্যযুগীয় পাণ্ডুলিপি। শিক্ষার্থীরা এই নিদর্শনগুলো দেখে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্বের ধারণা অর্জন করতে পারে।
তাজহাট শিক্ষণীয় সফরের জন্য আদর্শ। শিক্ষার্থীরা এখানে জমিদারি প্রথার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব, স্থানীয় শিল্প, ইউরোপীয় স্থাপত্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সরাসরি অনুধাবন করতে পারে। বিশেষ করে শীতকাল (নভেম্বর–ফেব্রুয়ারি) সফরের জন্য উপযুক্ত। স্থানীয় শিক্ষার্থীরা উল্লেখ করেছেন, এখানে গিয়ে তারা বইয়ের পাতার ইতিহাস নয়, বাস্তব ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে পারে।
প্রাসাদটি রংপুর শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
বাসে: ঢাকা থেকে গ্রীন লাইন, হানিফ, এসএ পরিবহন নিয়মিত রংপুরগামী; যাত্রা সময় ৭–৮ ঘণ্টা।
ট্রেনে: ঢাকা থেকে “রংপুর এক্সপ্রেস” বা “পঞ্চগড় এক্সপ্রেস” রংপুর রেলস্টেশনে; রেলস্টেশন থেকে অটোরিকশা/ইজিবাইকে ১৫–২০ মিনিট।
বিমানপথে: সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে রংপুর শহরে গাড়িতে ৩০ মিনিট। শহর থেকে অটোরিকশা বা সিএনজিতে সহজে পৌঁছানো যায়।
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় ৫.২৯ লক্ষ বিদেশী পর্যটক দেশে ভ্রমণে এসেছিলেন। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা প্রায় ৬.৫ লক্ষ। যদিও তাজহাটের জন্য নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই, তবে প্রাসাদটি আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়।
প্রাসাদটি সংরক্ষিত হলেও পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা, তথ্যফলক এবং আন্তর্জাতিক পর্যটক সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পর্যটন ও শিক্ষামূলক সফরের জন্য এটি আরও উন্নত করা গেলে আন্তর্জাতিক পর্যটক ও শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ আরও বাড়বে।
তাজহাট জমিদার বাড়ি কেবল একটি প্রাসাদ নয়; এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্থাপত্য এবং শিক্ষার এক প্রাণবন্ত পাঠশালা। শিক্ষণীয় সফর, স্থাপত্য সৌন্দর্য ও ভ্রমণের আনন্দ একসাথে উপভোগ করতে চাইলে এটি এক অনন্য গন্তব্য। প্রতিটি ইট ইতিহাস বলে, প্রতিটি সিঁড়ি স্মৃতি বহন করে। সঠিক সংরক্ষণ ও প্রচারণার মাধ্যমে এটি হতে পারে আন্তর্জাতিক পর্যটক ও শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ গন্তব্য।
ফিচার, লেখক
মো: জান্নাতী নাইম
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর


