নোমাইনুল ইসলাম, বাঘাইছড়ি (রাঙামাটি) প্রতিনিধি//
রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় চিকিৎসা সংকট ও অব্যবস্থাপনার কারণে ২৭ বছর বয়সী সান্ত্বনা চাকমার মৃত্যু স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মারিশ্যা পাকোয়াখালী গ্রামের এই প্রসূতি মায়ের মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং পার্বত্য অঞ্চলের দীর্ঘদিনের স্বাস্থ্য সংকটের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি।

আজ সকালে প্রসব বেদনা শুরু হলে সান্ত্বনা চাকমাকে স্বজনরা বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে প্রয়োজনীয় প্রসূতি চিকিৎসক ও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধার অভাব থাকায় কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত তাকে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেন। প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টার দুরত্ব পাড়ি দেওয়ার পথে গাড়ির ভেতরেই সন্তানের জন্ম দেন তিনি। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে গেলে হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই তার মৃত্যু হয়।
বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুমোদিত চিকিৎসক পদ থাকলেও অধিকাংশ শূন্য। যারা কর্মরত আছেন তারাও অতিরিক্ত চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিশেষ করে জরুরি চিকিৎসা, প্রসূতি সেবা, শিশু ও হৃদরোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। আধুনিক ল্যাব, আইসিইউ, পর্যাপ্ত ওষুধ কিংবা জরুরি যন্ত্রপাতি না থাকায় কার্যকর চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় অবস্থিত বাঘাইছড়ির যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল। স্থল ও নৌপথ থাকলেও সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনায় জরুরি রোগীকে দ্রুত জেলা সদর কিংবা বড় শহরে পাঠানো সম্ভব হয় না। ফলে চিকিৎসার জন্য সময় অপচয় প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতাল ও উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো কার্যত অচল। কর্মী সংকট ও সরঞ্জামের অভাবে এসব কেন্দ্রে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাও পাওয়া যায় না। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েন গরিব, অসচ্ছল ও দুর্গম এলাকার মানুষ। সাধারণ জ্বর-সর্দি থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপারেশনের জন্য তাদের খাগড়াছড়ি বা চট্টগ্রামে যেতে হয়, যা ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।
একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, “প্রতিটি মায়ের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবার অভাবে এখানে তা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
স্থানীয়দের দাবি—
প্রসূতি, শিশু, হৃদরোগ ও জরুরি চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ করতে হবে।
আধুনিক ল্যাব, আইসিইউ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।
দুর্গম অঞ্চলের জন্য দ্রুতগামী পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
ইউনিয়ন পর্যায়ের হাসপাতাল ও উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পর্যাপ্ত কর্মী ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে।
পার্বত্য এলাকায় আঞ্চলিক মেডিকেল কলেজ ও আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে।
সান্ত্বনা চাকমার মৃত্যু পার্বত্য অঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের সংকট ও অবহেলার নগ্ন চিত্র তুলে ধরেছে। যোগাযোগ ও চিকিৎসা অবকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া এ ধরনের প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব নয়। এখনই যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে ভবিষ্যতে আরও বহু মানুষ একই পরিণতির শিকার হবেন।


