বিপ্লব মজুমদার, সাতক্ষীরা :
আমাদের মানুষ হিসেবে যে বিশেষ গর্ব সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কারণ বিশ্বের বিস্তীর্ণ লীলাভূমির নান্দনিক সৌন্দর্যের অংশ হলো মানুষ। সেই হিসেবে মনুষ্যত্ব হলো মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ। এই একটি মাত্র গুণের করণেই মানুষরূপী প্রাণীটি আজ পৃথিবী শ্রেষ্ঠ। বাস্তবিক অর্থে মানুষ নামক প্রাণীটির ভিতরে যদি মনুষ্যত্ব নামক উপাদানটি না থাকতো তাহলে পৃথিবীর এই শান্ত ও সুসভ্য সভ্যতার বিকাশ কখনোই ঘটতো না। অবশ্য এটা বিবর্তনের এক সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল।
আদিম কালে প্রস্তর যুগের পর থেকে নানা রকমের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মানব সভ্যতা আজকে যে বিস্ময়করভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তা একদিনে কখনোই সম্ভব ছিল না। এটা হচ্ছে মানুষের হাজার বছরের সংগ্রাম -সংঘাত প্রতিকূলতা ও অনুকূলতার নান্দনিক প্রতিফলন। কিন্তু এই প্রতিফলনকে আমরা কতটা শিল্পসাফল্যরূপে উপস্থাপন করতে পেরেছি সেটা ভেবে দেখার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সত্যিই কি আমরা মানুষ হিসেবে সকল ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আচরণটুকু ফুটিয়ে তুলতে পেরেছি?
নিয়মানুবর্তিতা, শুদ্ধাচার, আদব-কায়দা,স্নেহ, ভালোবাসা কিংবা সময়ের প্রয়োজনে সুশাসনের সুন্দর বাস্তবায়ন এই মানব সভ্যতায় শুধু লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কথা হলো- যে মানব সভ্যতার সু-উজ্জ্বল সম্ভাবনা গুলো আজকে বিশ্ব সভ্যতা তথা বিশ্ব মানব বিবেকের কাছে সমাদৃত সেই সভ্যতা আজ কলুষিত মনুষ্যত্বের কাছে নির্লজ্জভাবে আত্ম সমর্পণ করছে। ফলে সমাজ, সংসার, দেশ কিংবা বিশ্ব আজ সেই শান্তির সভ্য জগত থেকে মুখ থুবড়ে পড়ছে। হয়তো সঙ্গত কারণেই মুখ থুবড়ে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু কেনো এমনটা হচ্ছে? কেনো মানুষের তৈরি বিশ্ব সভ্যতার আকাশে বিষাক্ত মেঘের আনাগোনা?
তাহলে এর কারণটাই বা কী??মানুষ হিসেবে এই প্রশ্নটা আমাদের প্রত্যেকের মনে কোন না কোনভাবে ঘুরেফিরে বারবার অন্তরে উচ্চারিত হয়। সংক্ষেপে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গেলে -ঠিক এভাবে বলা যেতে পারে-হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের অর্জন করা জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি ও বিবেচনা যখন মানুষের বিরুদ্ধাচারণ করে তখন সংসার, সমাজ, দেশ সর্বোপরি গোটা বিশ্ব তার বিশ্বস্ত উচ্চারণের অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে এবং হুমকির সম্মুখীন হয়। মোদ্দা কথা হলো-মনুষ্যত্বের বেহায়াপনার নির্লজ্জ আত্মসমর্পণই এর মূল কারণ। আমরা চাকচিক্যের প্রতিযোগিতায় চিত্ররূপময় হয়ে উঠছি প্রতিনিয়ত তবে মানবিকতার আসল পাত্রটা থেকে যাচ্ছে অপূর্ণ। আমাদের এই অপূর্ণতাই বিশ্ব সভ্যতার সূর্যকে কালো মেঘে ঢেকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কথা হচ্ছে বিজ্ঞান যেমন মানুষের সাথে সম্পৃক্ত তেমনি সভ্যতা,আবিষ্কার কিংবা সংস্কৃতিও মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। সেই সাথে মানবিক গুণাবলি ও মানবিক আচরণও মানুষের সাথে সম্পৃক্ত। এই গুণটাকে বাদ দিয়ে অতি আশ্চর্য সব কীর্তি আদৌ কি পৃথিবীর প্রকৃত সভ্যতা বা সৌন্দর্যের শ্রীবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে?প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়।
মনুষ্যত্ব হলো সেই তত্ত্বগুণ বা উপাদান যা মানুষের হাতে গড়া এই মানব সভ্যতাকে সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে। কিন্তু মানুষের কামনা-বাসনা ও লোভ যখন জঘন্য রূপে মানুষকে গ্রাস করে তখনই মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। আর মনুষ্যত্বের এই অবক্ষয় বিশ্ব মানব সভ্যতার আগামী সম্ভাবনার পথে নিঃসন্দেহে অন্তরায়।
দিনে দুপুরে চুরি এটাকে আমরা যতই সামাজিক অবক্ষয় বলি না কেন; এটা মূলত মনুষ্যত্বেরই অবক্ষয়। নারীর শ্লীলতাহানি, সম্পত্তি গ্রাসে স্বজনের রক্তক্ষরণ, অসহায়ের আর্তনাদ, দুমুঠো খাবারের জন্য গরিবের হাহাকার কিংবা দুর্নীতিবাজদের পুকুর চুরি এসবগুলোই মনুষ্যত্ব অবক্ষয়ের প্রতিফলন। শুধু কি তাই! রাস্তায় দুর্ঘটনায় পড়া লোকটিকে দেখেও আমরা যখন পাশ কাটিয়ে চলে যাই, এটাও কি মনুষ্যত্বের অবক্ষয় নয়?
তাহলে একটা বিষয় স্পষ্ট ফুটে উঠছে যে, সমাজ আজ মনুষ্যত্বের সংকটে জর্জরিত। তাহলে এই মনুষ্যত্বের সংকট সমাধানে আমাদের করণীয় টা কি? আইনের শাসন দ্বারা আদৌ কি মনুষ্যত্বকে মজবুত করা কখনো সম্ভব হবে। এটাতো ভয় দেখিয়ে অপরাধকে দমিয়ে রাখা আর অপরাধের মাত্রাকে জমিয়ে রাখার সামিল।পারিবারিক মূল্যবোধই একমাত্র মনুষ্যত্বকে নতুনভাবে নতুন মাত্রা দিতে পারে।
হৃদয় থেকে যদি হৃদ্রতার উদ্রেক না ঘটে তাহলে উপঢৌকন কিংবা আইন দিয়ে সেই হৃদ্রতার উদ্রেক ঘটানো কখনোই সম্ভব নয়।
মনুষ্যত্ব হলো মানব জীবনের শান্তির শেষ বার্তা। আমরা যতই সভ্যতার চাদরে মুড়ে দিয়ে মানব সভ্যতার অস্তিত্বকে জানান দেয়ার চেষ্টা করি না কেন ;সেটা হবে মাকাল ফলের স্বরূপ। মনুষ্যত্বের এই বিশ্বস্ত ব্যাপ্তিকে মানব সভ্যতার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন পারিবারিক শিক্ষা, সংস্কার ও সহানুভূতি। মানব সভ্যতার আগামীর সংকটকে ঠেকানোর জন্য মনুষ্যত্বের সুন্দর ও সুষ্ঠু প্রয়োগ প্রয়োজন।কেননা মনুষ্যত্ব হচ্ছে মানুষের সংসার, সংস্কৃতি ও সভ্যতার হৃদপিণ্ড। যা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও বিকশিত। সুতরাং মনুষ্যত্বের অস্তিত্ব সংকট যে পুরো বিশ্ব সভ্যতার বিস্ময়কর ব্যাবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লেখক :বিপ্লব মজুমদার
বি.এ.অনার্স,এম.এ. (বাংলা)
সাতক্ষীরা
তারিখ :১১/১২/২৪