রতন রায়, রাজারহাট (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
সময়ের স্রোতে ভেসে যাওয়া স্মৃতিগুলো যখন একত্রে মেলে ধরা হয়, তখন তা হয়ে ওঠে প্রাণের মহোৎসব। ‘এসো মিলি প্রাণের বন্ধনে’— এই স্লোগানকে ধারণ করে কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় ১৯৯০ সালের ব্যাচের বন্ধুদের এক অনন্য মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিন দশক পরের এই আয়োজন ছিল হৃদয়জুড়ানো এক আবেগ-নস্টালজিয়ার সম্মেলন।

রাজারহাটের আব্দুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী অডিটোরিয়াম প্রাঙ্গণ জুড়ে শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক গাম্ভীর্য। ছিল শুধু হাসি, গল্প, আদর-কোলাকুলি আর ফেলে আসা স্কুল-কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণের এক অবারিত উৎসব। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি দূর থেকে অনেকেই ছুটে এসেছিলেন প্রাণের বন্ধুদের সঙ্গে কোলাকুলি করতে।
আয়োজনের শুরুতেই পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন আব্দুল মালেক এবং পবিত্র শ্রীগীতা থেকে পাঠ করেন শিক্ষক শ্রী রমেশ চন্দ্র রায়। ‘বন্ধু অ্যাসোসিয়েশন রাজারহাট ৯০ ব্যাচ’-এর সভাপতি মোঃ শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই মিলন মেলায় দুই শতাধিক বন্ধু-বান্ধবী উপস্থিত ছিলেন। দিনটি ছিল স্বরণী-বিস্মরণীর পালা।
একে একে সবার পরিচয় পর্ব ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে অনুষ্ঠান এগিয়ে চলে। এ সময় সকলের সামনে ভেসে উঠছিল অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ের ক্লাস-পরীক্ষা, শিক্ষকদের শাসন, খেলার মাঠের দুরন্তপনা, বাড়ি ফেরার পথের আড্ডা আর প্রথম যৌবনে পা রাখার নানা স্মৃতিময় গল্প। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বন্ধুরা শোনান জীবনের নানা অধ্যায়ের গল্প। কেউ কেউ আবেগ আড়াল করতে না পেরে চোখের জল মুছলেন। স্মৃতিচারণায় সভা কখনো হয়ে উঠেছে আবেগঘন, আবার কখনো হাসি-তামাশায় সরগরম।
আয়োজন কমিটির পক্ষ থেকে সঞ্চালনা করেন আব্দুর নুমান ও জয়নব খাতুন। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ রুহুল আজাদ সবুজ।
সবুজ তার বক্তব্যে বলেন, “আমাদের এই মিলনমেলা শুধু একটি রিয়ুনিয়ন নয়, এটি আমাদের বন্ধুত্বের অম্লান বন্ধনেরই স্বাক্ষর। কর্মব্যস্ততা আর সংসারের হাজার বাঁধা ডিঙিয়েই আজ আমরা এখানে জমায়েত হয়েছি। এটাই প্রমাণ করে, বন্ধুত্ব সময়ের করাল গ্রাসেও ম্লান হয় না।”
দুপুরের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বন্ধু সদস্যরা গান পরিবেশন করেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাওয়াইয়া বাংলাদেশ বেতার শিল্পী ৯০ ব্যাচের “শফিকুল ইসলাম (সফি), শ্রী রমেশ (শিক্ষক) , বেলা রানী, শহিদুল ইসলাম, সবুজ ও কবিতা। বান্ধবীদের জন্য বালিশ খেলা ও নৃত্যের মাধ্যমে পুরস্কার বিতরণের মধ্য দিয়ে উপস্থিত সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন শিল্পীরা। একসময়ের দুরন্ত ছেলেটি আজ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আর মেধাবী সেই মেয়েটি আজ বিচারপতি— সবার মধ্যেই যেন ফিরে এসেছিল স্কুলের সেই অকৃত্রিম রূপ।
শুধু অতীত স্মৃতিচারণেই সীমাবদ্ধ থাকেনি এই আয়োজন। সামনে আরও নিয়মিত মিলনের পাশাপাশি একটি স্থায়ী কাঠামোর মাধ্যমে সমাজসেবামূলক কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।
ঢাকা থেকে আসা এক বন্ধু, যিনি এখন একজন অফিসার ইনচার্জ কর্মকর্তা, বলেন, “৩০ বছর পরে যখন সবার মুখ দেখছি, মনে হচ্ছে সময় যেন থেমে আছে। আমরা আবারো সেই ক্লাস এইট-নাইনের ছাত্র-ছাত্রী। এমন আয়োজন আমাদের হারানো ফিরিয়ে আনে।”
অনুষ্ঠানে একত্রে দুপুরের খাবারের মাধ্যমে। রাজারহাটের সেই সন্ধ্যা সাক্ষী থাকল বন্ধুত্বের এক অমর বন্ধনের।


